কোন ক্যামেরা কিনব?

সেন্সর আকার

আলোচনা শুরু করা যাক সেন্সর সাইজ দিয়ে। আলোচ্য ক্যামেরাগুলির মধ্যে সবচাইতে ছোট সেন্সর সাইজ হচ্ছে স্মার্ট ফোনের। সবচাইতে বড় হল ডিএসএলআর এর। সেন্সর সাইজের সাথে ইমেজ গুনের সরাসরি সম্পর্ক আছে। ইমেজ গুন মানে পরিষ্কার ছবি, রঙের গভীরতা, আলোর সামঞ্জস্য, ডাইন্যামিক রেঞ্জ ইত্যাদি। স্বাভাবিক ভাবেই মনে হতে পারে যে ডি এস এল আর এর পাশে স্মার্ট ফোন নস্যি। আসলেই কি তাই? আজকাল নেট জুরে স্মার্ট ফোন দিয়ে তোলা ক্যামেরার যে ইমেজ আমরা দেখি তাতে করে কি এই মতামত আর দেয়া সম্ভব? এরপর দেখুন এখানে বিভিন্ন আকারের সেন্সর সাইজের সমাহার। স্মার্ট ফোন ছাড়া ব্রিজ ক্যামেরার সেন্সর আকার সবচাইতে ছোট। সাধারণ আলোকোজ্জ্বল দিনে এই ক্যামেরাগুলি দিয়ে তোলা ছবির পার্থক্য হয়ত দৃশ্যমান হবেনা, তবে স্বল্প আলোয় এই পার্থক্য স্পষ্ট হতে থাকবে।

মেগাপিক্সেল

মেগাপিক্সেল নিয়ে বেশী আলোচনা না করাই শ্রেয়। আমাদের যাদের দেয়াল সাইজের ছবি প্রিন্ট করার দরকার নেই তাঁদের জন্য স্মার্ট ফোনের যে ৮ মেগাপিক্সেল দেখছি, সেটাই যথেষ্ট।

আই এস ও

আজ থেকে মাত্র কয়েক বছর আগেও আই এস ও নিয়ে কাউকে মাথা ঘামাতে শুনিনি। এখন এই আই এস ও দেখে অনেকে শুনি ক্যামেরা কেনার সিদ্ধান্ত নেন। ক্ষেত্র বিশেষে এটা অনেকখানি যৌক্তিক হলেও একটি বিষয় মনে রাখা দরকার যে আই এস ও এর সাথে লেন্সের এপারচার মূল্য এবং সেন্সর সাইজের সম্পর্ক আছে। যেমন উদাহরণ হিসেবে আমরা ব্রিজ ক্যামেরা সনি এইচ এক্স ৩০০ কে ধরতে পারি। এই ক্যামেরার সর্বোচ্চ আই এস ও হচ্ছে ১২৮০০। কিন্তু এর সেন্সর সাইজ বেশ ছোট, টিপিকাল লো এন্ড কমপ্যাক্ট ক্যামেরার যেমন হয় আর এর লেন্সের এপারচার দেখুন– ২.৮ থেকে ৬.৩। কাজেই আই এস ও বেশী থাকার পরেও শুধু এপারচারের কারণে স্বল্প আলোয় এই লেন্স দিয়ে তোলা ছবি হোঁচট খাবে বারবার। একই ছবি অন্যান্য ক্যামেরায় হয়ত উৎরে যাবে শুধু এপারচার মূল্য বেশী থাকার কারণে।

এল সি ডি

আধুনিক ক্যামেরার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। ছবি তুলুন আর মুহূর্তের মধ্যে দেখে নিন কেমন হল, খারাপ উঠলে আবার তুলুন। এখানে বিস্ময়কর হলেও সত্যি, স্মার্ট ফোন এগিয়ে আছে অনেক খানি। শুধু যে উল্লিখিত ফোন ক্যামেরার এল সি ডি ৫ ইঞ্চি তাই নয়, এদের রেজুলিউশনও অনেক বেশী। কাজেই ছবি তুলে তা দেখার মতন আরাম আর অন্য কোনও ক্যামেরায় আপনি পাবেন না। তবে তার মানে এই নয় অন্য ক্যামেরাগুলির এল সি ডি ভাল নয়। সবগুলিই ভাল, শুধু স্মার্ট ফোনের চাইতে খানিক পিছিয়ে আছে। রেজুলিউশন হয়ত বাড়ানো সম্ভব যুগের সাথে তাল মিলিয়ে, তবে এইসব ক্যামেরায় ৩ ইঞ্চির জায়গায় ৫ ইঞ্চি আকার বাড়িয়ে দেয়াটা কঠিনই হবে। কমপ্যাক্ট ক্যামেরা তার ছোট আকারের ফর্ম ফ্যাক্টরের জন্যই কিন্তু সমাদৃত, শুধু এল সি ডির কারণে ক্যামেরার ভৌত কাঠামোর আকার বাড়ানোটা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে।

ভিউ ফাইন্ডার

এখানে যে ক্যামেরাগুলি নিয়ে আলোচনা হয়েছে একমাত্র ডি এস এল আর এবং ব্রিজ ক্যামেরা ছাড়া আর কোনও মাধ্যমেরই কিন্তু ভিউ ফাইন্ডার নেই। ফর্ম ফ্যাক্টরের কাছে ভিউ ফাইন্ডারকেও হার মানতে হয়েছে। ছোট পকেট ক্যামেরায় আবার কিসের ভিউ ফাইন্ডার- এটাও ভাবতে পারেন কেউ কেউ! যারা দীর্ঘদিন ডি এস এল আর ব্যাবিহার করেছেন, তাঁদের কাছে এটি কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারপরেও বলা যায় এখনকার এল সি ডি গুলি (যেগুলি ভিউ ফাইন্ডার এর কাজ করে) তুলনামুলক ভাবে অনেক কম দ্রুতগতিসম্পন্ন হলেও ছবি তোলার রেস্পন্সিভনেস তাদের যে খুব খারাপ, তা আর বলা যাবেনা।

সাটার স্পিড

সাটার স্পিডের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন মূল্য ছবি তোলার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সর্বনিম্ন সাটার স্পিড উপরোক্ত সব ক্যামেরার কম বেশী এক, তবে এই একটি ক্ষেত্রে নাইকনের ১ ইঞ্চির সেন্সর ক্যামেরা সবাইকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। তাদের সর্বোচ্চ সাটার স্পিড ১ সেকেন্ডের এক ভাগের ১৬০০০ ভাগ। এটি এক কথায় অবিশ্বাস্য। এমন সাটার স্পিড সম্পন্ন কোন ক্যামেরার কথা আজ পর্যন্ত শুনিনি। এই সাটার স্পিডে ঠিক কত পরিমান গতিকে স্টিল করে সম্ভব, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ হলেও আপনার ছোট শিশুর যে কোন গতিকে তা ধারণ করতে পারবে। এটি একটি ক্যামেরার অনন্য গুন হিসেবে সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব।

ওজন

উপরোক্ত তালিকায় দেখা যাচ্ছে যে স্মার্ট ফোনের ওজন যৌক্তিক ভাবেই কম। আর সবচাইতে বেশী ওজন সনির ব্রিজ ক্যামেরার। সাধারণত ডি এস এল আর ক্যামেরার ওজন বেশী হওয়াটাই যৌক্তিক, তবে ক্যাননের এই নতুন ডি এস এল আর এর হালকা পাতলা ওজনের জন্যই খ্যাতি পেয়েছে বেশী। পকেট কমপ্যাক্ট ক্যামেরা ক্যানন এস ১১০ এর ওজনও নেহায়েতই কম।

লেন্স

সাতটি ক্যামেরার তিনটি রিফ্লেক্স। কাজেই যে কোন লেন্স আপনি তাতে যোগ করতে পারেন। বাকি চারটি ক্যামেরার লেন্সগুলির মধ্যে সবচাইতে বেশী আলোচনা করার মতন হচ্ছে সনির ব্রিজ ক্যামেরার। ২৪-১২০০ মিমি একটি সাংঘাতিক রেঞ্জ। এই রেঞ্জ দিয়ে মনে হয় জগতের তাবৎ ফটোগ্রাফিক মুহূর্তকে ধারণ করা সম্ভব। আজকাল এইসব সুপার জুমের বেশ চাহিদাও লক্ষ্য করা যায়। তবে এই লেন্সের সমস্যা হল এর ২৪ মিমি এন্ডে এপারচার মূল্য ২.৮ এবং ১২০০ তে ৬.৩। সমস্যা অন্য কিছুতে নয় বরং স্বল্প আলোয়। আর বাকি অন্যান্য লেন্সগুলির জুম রেঞ্জ গতানুগতিক, রিফ্লেক্স ক্যামেরার কিট লেন্স সহ। মজা হচ্ছে স্মার্ট ফোনের লেন্স কিন্তু প্রাইম লেন্স। ৩০ মিমি এফ ২.৪। এই লেন্স স্বল্প আলোয় ভালো ছবি উপহার দেবে বলে মনে হয়।

ভিডিও

ভিডিওর ব্যাপারে আমি আগেও বলেছি যে স্থিরচিত্র ধারণকারী ক্যামেরায় ভিডিও ধারণ ব্যাক্তিগত ভাবে আমার ভাল লাগে না। কিন্তু শৌখিন ক্যামেরাম্যানদের চাহিদার চোটে এর গ্রহনযোগ্যতাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এই জায়গায় সবগুলি ক্যামেরাই কিন্তু কমবেশি এগিয়ে আছে। বিশেষ করে ফুল এইচ ডি মুভি ধারণ করা এইসব ক্যামেরায় এখন ছেলেখেলার মতন। তবে স্টেরিও সাউন্ড এখন বেশ জনপ্রিয়। সব ক্যামেরায় এই সাউন্ড সুবিধে নেই। লেন্সের এপারচার মূল্য এক্ষেত্রে ভালো ভূমিকা রাখে। আমি নিজে ক্যানন এস ১১০ দিয়ে ভিডিও করে দেখেছি। স্বল্প আলোয় দারুন ভিডিও হয়, যদি এক্সপোজার একটু বাড়িয়ে নেয়া যায়।

হট শু

ক্যামেরার ওপর একটা হট শু থাকার সবচাইতে বড় সুবিধে হল, এটার ওপর ভর করে আপনি একটি বহিরাগত ভিউ ফাইন্ডার এবং একটি ফ্ল্যাশ বসাতে পারেন। ফ্ল্যাশের সুবিধে তো বলে শেষ করা যাবেনা। আগ্রহী ফটোগ্রাফারদের জন্য এটি একটি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। যদিও কমপ্যাক্ট ক্যামেরার ফর্ম ফ্যাক্টরের কাছে এই সুবিধেটুকু কম্প্রোমাইজ করা ছাড়া আর উপায় থাকেনা। তাই যৌক্তিক কারণেই ছোট ক্যামেরায় এই সুবিধেটুকু অনুপস্থিত।

ওয়াই ফাই, জি পি এস

এই দুটি প্রযুক্তি ক্যামেরার কানেক্টিভিটির সাথে সম্পর্কিত। আর বলা যায় এখানেই ক্যামেরার ভবিষ্যৎ লুকিয়ে আছে। তাই আধুনিক যে কোন ক্যামেরাই এই সুবিধেগুলি থেকে নিজেদের আর মুক্ত রাখতে পারছেনা। বিশেষ করে স্মার্ট ফোনের কানেক্টিভিটির কাছে ছোট কমপ্যাক্ট ক্যামেরাগুলি এই সুবিধের জন্য মার খেয়ে বসেছে। দুটি প্রযুক্তিই নতুন। আলোচ্য ক্যামেরাগুলির মধ্যে একমাত্র ক্যানন এস ১১০ ক্যামেরারই দেখছি ওয়াই ফাই রয়েছে। যদিও অন্যান্য ক্যামেরায় এই সুবিধে এখনও প্রাপ্য নয় তবে বলা যায় সেদিন আর দূরে নয় যখন এই দুটি প্রযুক্তি সকল ক্যামেরায় থাকবে।


আমরা যে মুল্যমানের ক্যামেরা নিয়ে এখানে আলোচনা করছি তাতে র সুবিধে থাকবেনা তা হয়না। কিন্তু দেখছি সনির ব্রিজ ক্যামেরায় এটি যুক্ত হয়নি। এটি বিস্ময়কর এবং মেনে নেয়া যায়না আসলে। স্মার্ট ফোন যেখানে নানান গবেষণায় লিপ্ত যে কিভাবে এটি ইন ক্যামেরায় ঢোকানো যায় সেখানে $ ৪০০ এর ক্যামেরায় তা থাকবেনা, এটা অদ্ভুত!

শেষ কথা

আজ আমাদের তুলনামুলক আলোচনার এখানেই ইতি। আসলে ৩০,০০০ থেকে ৪০,০০০ টাকার মধ্যে কোন্ ক্যামেরা ভাল হবে এটি ভীষণ সাব্জেক্টিভ একটি প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর সবসময় ক্যামেরার স্পেসিফিকেশন থেকেও পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ স্পেসিফিকেশন আমাকে কিছু তথ্যের সন্ধান দেয় বটে তবে সেখান থেকে আমার ভালো লাগার তথ্য সবসময় নিহিত নেই। যে ব্যাক্তি কমপ্যাক্ট ক্যামেরা পছন্দ করেন, যে ব্যাক্তি চান এমন একটি ক্যামেরা যেটি সহজেই পকেটে ঢুকবে তাকে হাজার চেষ্টায় বলে কয়েও ডি এস এল আর কেনানো সম্ভব নয়। আবার যে ব্যাক্তি একটি ডি এস এল আর কেনার মনস্থ করেছেন তিনি স্মার্ট ফোনের ক্যামেরার দিকে পাত্তাই দেবেন না! আবার একই ব্যাক্তিমানুষের হাতে সব থাকতে পারে। এটিও বিচিত্র নয়!